ভ্যালেন্টাইন স্পেশ্যাল

 মুখে মারের কালশিটে দাগটা দেখে মা হাসলেন, বললেন,

 “কিরে? প্রেমিক স্বামী বুঝি গায়েও হাত তুলে?”

মায়ের আচমকা কথায় আমি থতমত খেলাম। কথাটি বোধগম্য হতেই তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে গালের দাগটা লুকানোর বৃথা চেষ্টাই যা করলাম। মা-তো যা দেখার ততক্ষণে দেখেই ফেলেছেন। 

মায়ের কথাটি বাবার কান অব্দিও যে আরামসে চলে গিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না আমার। কারণ বাবা আমার সামনেই বসে চা খাচ্ছিলেন। কথাটা শুনেই তিনি আড়চোখে আমাকে পরখ করে নিলেন। সত্যিই কী মারের দাগ পড়েছে?



আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লেন, 

 “কিরে? তোকে মারে নাকি?”

এবার জবাবটা দিলেন বাবা, তা-ও ভীষণ তাচ্ছিল্যে, “উত্তর দিবে নাকি এখন? শখ করে বিয়ে করেছে না। এখন মারলেও বলার মুখ আছে ওর? বাবা-মা'র কথা শুনেনি। এবার ফল ভুগবে।”

আমি নতজানু হয়েই রইলাম। সত্যিই তো, বলার মুখ আছে না-কি আমার! ভালোবেসে বিয়ে করেছি, সে ভালোবাসার দুর্নাম কীভাবে করি? এই ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না বলে টানা চারদিন না খেয়ে ছিলাম। মা তো একদিন রেগে আমার হাতে গরম খুন্তিও লাগিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমি ছিলাম আমার সিদ্ধান্তে অটল। সেই ছেলেকে ছাড়া বাঁচবো না জানিয়ে দেওয়ার পর বাবা-মা অনিচ্ছা স্বত্তেও বিয়ে দিয়েছিলেন। 

একসময় যে ছেলেকে ছাড়া বাঁচবো না বলেছিলাম, আজ কীভাবে বলি যে, এই ছেলের সঙ্গে থাকলে এখন আমি বাঁচবো না? বলার যে মুখ নেই আমার! সেদিন ভালোবাসা ছিলো তাই কণ্ঠে জোর, বুকে সাহস ছিল। কিন্তু আজ যে চারপাশে কেবল আফসোস। আফসোসের জীবনে জোর থাকে না, সাহসও থাকেনা। থাকে কেবল হতাশা। 

কথা আর বাড়ল না। বাবা ড্রয়িং রুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। মায়ের ঠোঁটে তখনও ঐ কেমন হেয়-র হাসিটা লেগেই ছিল। আচ্ছা, মা কী খুশি হলেন? তার কথা শুনিনি বলে আজ এমন চিতায় জ্বলছি দেখে কী নিজেকে বিজয়ী ভাবছেন? 

আমার কেন যেন আর সে হাসিটা সহ্য হচ্ছিলো না। তাই ছুটে চলে গেলাম নিজের 

আজ বুধবার। সাহেল, আমার স্বামী আমাকে নিতে এসেছে। তার সাথে ঝগড়া করেই বাবার বাড়িতে আসা। ঝগড়া বলা যায় না, বলা যায় অসহনীয় মা-র থেকে বাঁচতেই আমার এখানে পালিয়ে আসা। বিয়ের পর প্রথম বার এসেছি বাবার বাড়ি। তাও সাত মাস পর। বাবা-মা কখনো নাইয়র আনতে যায়নি রাগে। আমিও আর লজ্জায় কখনো আসতে পারিনি। কিন্তু এবার লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়েই আসলাম। বাঁচতে হবে বলেই সব বিসর্জন দেওয়া। গত সাত মাসে সাহেল আমার জীবন যেভাবে নরক বানিয়েছে, সে নরক নিয়ে বাঁচা দায়। এমন একটা দিন বাদ নেই যে তার হাতে মার খাইনি। ব্যাথায় কতবার জ্ঞান হারিয়েছে তার হিসেবে আজ থাকুক।

বিয়ের আগে যে সাহেলকে চিনে ছিলাম, জেনে ছিলাম— সে সাহেলকে আর খুঁজে পাইনি আমি বিয়ের পর। যত্নশীল সাহেল রূপ বদলে হয়ে গিয়েছিল পাষাণ। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, অনেকটা......

মা সাহেলকে তেমন আপ্যায়ন করলেন না। অপছন্দের মেয়ে জামাই বলে নাকি অত্যাচারী মেয়ে জামাই বলে ঠিক বুঝলাম না। সাহেলকে ড্রয়িংরুমে বসিয়েই তিনি আমাকে তৈরী হওয়ার তাড়া যখন দিতে আসলেন আমি দ্বিতীয়বার সকল লজ্জা ভেঙে মায়ের পা ধরলাম। কত আকুতি মিনতি করে বললাম,

 “মা গো, ও মা, আমায় তোমরা রেখে দেও তোমাদের কাছে। আমাকে সাহেল খুব মারে। আমার সয় না শরীরে সেই মার। মা গো, আমার ভীষণ যন্ত্রণা হয়। আমাকে রেখে দেও মা।”

মায়ের মন যেন সাহেলের থেকেও পাষাণ হয়ে গেলো। আমাকে মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন,

 “শখ করে মার বেছে নিয়েছো, এখন সয়ে নেও।”

আমি আর ভাষা পেলাম না। বললাম না কিছু। মা'কে বলতে পারলাম না— মা, আমি যে শখ করে ভালোবাসা বাছতে গিয়েছিলাম। ভালোবাসার বাজারে যে ভালোবাসার মোড়কে প্রতারণা বিকায় আমি বুঝিনি মা। বুঝবোও বা কীভাবে? যে বাবা-মাকে এতবছর চিনলাম পরম শুভাকাঙ্খী হিসেবে সে বাবা-মাকেই যে আজ বড়ো অচেনা লাগছে। তবে সাহেলেরই বা কী দোষ দিই?

কিন্তু বলা আর হয়ে উঠে না। কত না বলা কথাই তো পরে থাকে জীবনের আনাচে-কানাচে। এটাও থাক। 

অবশেষে বাঁচার জায়গা না পেয়ে যখন সাহেলের সাথেই রওনা দিলাম তখন বাবা বললেন,

 “এবার এসেছো ভালো কথা, পরের বার আর এ বাড়িতে পা দিও না। নেহাৎ ভদ্রলোক বলে গলা ধাক্কা দিইনি তোমার। এসে পড়েছ বলে ঢুকতে দিয়ে ছিলাম। আর কখনো এসো না মরে গেলেও। এ মুখ আর দেখিও না।”

আমি বললাম না কিছু। বাবা কী অভিমান করে বললেন এটা? আমার মারের দাগের চেয়েও অভিমান গাঢ় বুঝি! জানা হলো না আর। 

ঘর থেকে বেরিয়েই সাহেলের প্রথম চ ড়টা খেলাম। আমার জন্য শ্বশুর বাড়িতে তাকে অপদস্ত হতে হয়েছে বলে। আমি অন্যবার শব্দ করলেও আজ শব্দ করলাম না। সাহেলকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কেবল বললাম— ভালোবাসি!

সাহেল বকলো। গালিগালাজ করল। অকথ্য ভাষা সব। বলল, আমি নাকি নাটক করে ভালোবাসি বলেছি। কিন্তু সাহেল ভুল। আমি নাটক জানিনা। আমি মন থেকেই বলেছিলাম। সাহেল দূরের মানুষ হয়েও একটা সময় আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই। আজ সময়ের পরিবর্তনে সে পাষাণ কিন্তু এক সময় তো ঠিক যত্নশীল ছিল। যেখানে রক্তের বাবা-মা আমারে বুঝলো না সেখানে সাহেলের এই একসময়ের ভালোবাসা তো উপরি পাওনাই ছিল আমার জীবনে। তাহলে তাকে তো 'ভালোবাসি' বলতেই হয়! কৃতজ্ঞতা স্বরূপ।

_

আজ শুক্রবার। রাত কয়টা হবে? আনুমানিক সাড়ে তিনটা। অঝোর বৃষ্টিতে ভিজছি আমি। শীতল চারপাশ। ছাতা ধরার কেউ নেই। অথচ এই বটগাছটার নিচেই আমি আর সাহেল আড্ডা দিতাম। বৃষ্টি হলে আমার ছাতা হতো আমার সাহেল। অথচ আজ.......

আফসোস! কাল যখন সবাই আমাকে দেখবে, তখন বলবে হা-হুতাশ করে “এত হাসিখুশি মেয়েটা আ ত্ম হ ত্যা করল! আহারে!”

অথচ কেউ জানবে না, কত কান্নার গল্প লুকিয়ে আমি হাসতাম!

আচ্ছা, বাবা কী আমায় দেখতে আসবে একটি বার? 

বাবা শুনছো, তোমার রজনী তার এ মুখ আর দেখাবে না। এবার তুমি খুশি তো বাবা? তুমি জিতে গেছো, বাবা। তোমার রজনী ভুল মানুষ বেছে নিয়ে ছিল জীবনে। তোমার কথা শুনেনি। তাই তার এই হাল। তুমি বিজয়ী, বাবা। রজনী তার শাস্তি পেয়েছে। খুশি তো এবার, মা তুমি?

সাহেল কী কাঁদবে একটিবার আমায় ধরে? মিথ্যে করে হয়তো কাঁদবে। সবাই বাঁচতে চায়। সাহেলও বাঁচতে চাওয়ার জন্য কাঁদবে। নিজেকে বেচারা প্রমাণ করার জন্য কাঁদবে। আর কেউ না জানলেও সাহেল জানবে, আমি মরতে চাইনি। সাহেল রাগের বশে আমার তলপেটে এত জোরে আঘাত করার পরেও আমি বাঁচতে চেয়ে ছিলাম। সাহেল আমাকে হসপিটালে নিলে হয়তো বেঁচে যেতাম। 

থাক সাহেল, তুমিই বেঁচে থাকো। ভালো ভাবে বেঁচে থাকো। আমি নাহয় আজন্মকালের মতন ভালোবেসে পাপী হয়ে ঘুমিয়ে থাকব আঁধার কবরে। 

সাহেল, ভালোবাসা সবসময় নতুন থাকে না কেন বলো তো? তাহলে তো আমার সাহেল আমারই থাকতো বরাবর। 

শুনছো সাহেল, পরেরবার ভালোবাসলে মেয়েটার ভরসা হইও। মেয়ের বাবা যেন নিজেকে বিজয়ী ভাবতে না পারে মেয়ের প্রেমিক ভুল মানুষ বলে। 

মনে থাকবে, গো?

Post a Comment

0 Comments