শেষ বিকেলের প্রেম

শীতের শেষ বিকেল। শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। সূর্যের রঙ লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। এই সময় ঢাকা শহরের এক ক্যাফেতে বসে আছে অর্ণব, একসময়কার উচ্ছল, প্রাণবন্ত এক তরুণ। এখন তার চোখের কোণে অবসাদের ছায়া।

অর্ণবের সামনে রাখা কফির কাপ ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে, কিন্তু তার দৃষ্টি একপাশে থাকা জানালার বাইরে স্থির। হঠাৎই ক্যাফের দরজা খুলে গেল, আর ভিতরে প্রবেশ করল একজন মেয়ে—তিথি। লম্বা কালো চুল, চোখ দুটো টানা, আর পরনে নীল শাড়ি। অর্ণব এক মুহূর্তের জন্য যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল।

তিথি—অর্ণবের কলেজ জীবনের প্রেম। তারা একসময় একে অপরের পৃথিবী ছিল, কিন্তু সময়ের নিয়মে দূরে সরে গেছে।

তিথি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল, "অর্ণব, কেমন আছো?"

অর্ণব একটু হেসে বলল, "ভালো… আর তুমি?"

তিথির চোখের কোনে অদ্ভুত এক আবেগ খেলা করছিল। "ভালো আছি। তবে কিছু স্মৃতি এখনো খুব বেশি জীবন্ত মনে হয়!"

অর্ণব বুঝতে পারছিল, তিথি ঠিক কী বলতে চাইছে। তাদের সম্পর্কটা কোনো ঝগড়ায় ভেঙে যায়নি, বরং বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতির কাছে হার মেনেছিল। তিথির বাবা-মা তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, আর অর্ণব তখন নিজের ক্যারিয়ারের জন্য যুদ্ধ করছিল। দুজনেই পরস্পরকে ভালোবাসত, কিন্তু সেই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

তিথি একটু হেসে বলল, "তুমি এখনো কফি খাও?"

অর্ণব মৃদু হাসল, "হ্যাঁ, তবে একা খেলে আর আগের মতো স্বাদ লাগে না!"

তিথি একটুখানি চুপ থেকে বলল, "আমাদের সময়গুলো কী সুন্দর ছিল, তাই না? প্রতিদিন ক্লাস শেষে কফিশপে আসা, একসঙ্গে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে ঘোরা…সবকিছু এত আপন ছিল।"

অর্ণব একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "হ্যাঁ, কিন্তু সময়ের নিয়ম বদলায় না, তিথি!"

তিথি একটু দম নিলো। "অর্ণব, তুমি কি কখনো জানতে চাওনি, আমি কেমন আছি?"

অর্ণবের কণ্ঠ একটু ভারী হয়ে গেল। "তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, তাহলে আমি কখনোই ভুলতে পারিনি। তুমি আমার জীবনের সেই অধ্যায়, যা কখনো বন্ধ হয়নি। আমি আজও তোমার জন্য অপেক্ষা করি, তিথি!"

তিথির চোখ দুটো চিকচিক করছিল। সে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, "তাহলে কি খুব দেরি হয়ে গেছে?"

অর্ণব চুপ। এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "তুমি যদি চাও, তাহলে আমরা আবার শুরু করতে পারি।"




তিথি অবাক হয়ে তাকাল। "সত্যি? তুমি এখনো…?"

অর্ণব মৃদু হাসল। "ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, তিথি। শুধু সময়ের সঙ্গে তার রঙ বদলায়। যদি আমরা চাই, তাহলে আবার সেই পুরনো রঙে রাঙিয়ে নিতে পারি!"

তিথি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, "তাহলে চলো, আরেকবার কফি খাই, যেমনটা আগে খেতাম।"

সেদিনের শেষ বিকেলের আলোয়, দুজনের মধ্যে পুরনো প্রেম আবার জেগে উঠল। অতীতের সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি, কষ্ট আর অপেক্ষা মুছে গিয়ে নতুন এক সূর্যোদয় হল তাদের জীবনে। কারণ, ভালোবাসা কখনো মরে না, শুধু অপেক্ষা করে সঠিক সময়ের জন্য!


পরবর্তী দিনগুলোতে, অর্ণব ও তিথি ধীরে ধীরে পুরনো বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পথে ফিরে যেতে থাকে। তারা নিয়মিত দেখা করতে থাকে, নিজেদের জীবনের গল্প শেয়ার করতে থাকে। তিথি বলল, "জানো অর্ণব, আমি কখনোই ভাবিনি যে আমরা আবার এভাবে একসঙ্গে বসব।"

অর্ণব মৃদু হেসে বলল, "আমিও না, কিন্তু হয়তো আমাদের গল্পটা শেষ হয়নি তখনই। সময় আমাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।"

তারা ধীরে ধীরে নিজেদের জীবনের সমস্ত ব্যথা ও কষ্ট ভুলতে শুরু করল। একদিন, অর্ণব তিথিকে নিয়ে পুরনো কলেজের সামনে নিয়ে এল। "এখানে কত স্মৃতি জমে আছে, তাই না?" তিথি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলল, "হ্যাঁ, এই জায়গাটা আমাদের গল্পের শুরু ছিল।"

অর্ণব বলল, "তাহলে কেন না আবার নতুন করে শুরু করি?"

তিথির চোখে জল এসে গেল। "তুমি কি সত্যি বলছো?"

অর্ণব মাথা ঝাঁকালো, "তোমার হাতটা ধরতে চাই, চিরদিনের জন্য।"

তিথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "আমি রাজি!"

এভাবেই তাদের প্রেমের গল্প নতুন রঙে রাঙিয়ে উঠল। পুরনো ভুল বোঝাবুঝি ও দূরত্ব কাটিয়ে তারা আবার একে অপরের ভালোবাসায় নতুন জীবন খুঁজে পেল। ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে যায় না, শুধু সময়ের সঙ্গে তার গভীরতা আরও বাড়ে!

Post a Comment

0 Comments