বর্ষার এক সন্ধ্যায় নবনী স্কুল থেকে ফিরছিল। হঠাৎ বৃষ্টি নামল। ছাতা ছিল না। সে এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে ভিজছিল, চোখে-মুখে বিরক্তি। ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ একটা ছাতা ধরে তার মাথার উপর—
"তোমার এই ভিজে যাওয়ার অভ্যাস তো আজও গেল না.."
নবনী চমকে তাকায়।
বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে নবনী—চুপচাপ। চারপাশে শুধু রিমঝিম শব্দ, আর হৃদয়ের নরম স্পর্শ। সব কিছু যেন থমকে গেছে।
নবনী ধীরে বলে, অয়ন!"তুমি.. সত্যি?"
অয়ন হেসে বলে,
"তুমি জানো না, তুমি যেখানে থাকবে—আমি ঠিক সেখানে ফিরব।"
পাঁচ বছর পর... সামনেই দাঁড়িয়ে, ছাতার নিচে, চোখে সেই পুরনো চাহনি।
অয়ন ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বলে, "যখন তোমার সাথে দেখা হলো, আমি জানতাম—এটাই ছিল আমাদের শেষ না হওয়া গল্পের প্রথম শুরু।"
নবনী কিছু বলে না, তার চোখের কোণে ছোট্ট জল—ভিজে চোখে এক টুকরো পুরনো স্মৃতি ফুটে ওঠে। সেই দিনগুলো, যখন তারা একে অপরকে চিরকাল ভালবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।
অয়ন তার হাত ধরে আস্তে বলল, "আমি জানতাম, তুমি অপেক্ষা করছিলে—শুধু সময়ের পেছনে নয়, আমার জন্য। তুমি জানো, আমি তোমার ভালোবাসার কাছে ফিরে এসেছি।"
ঠিক এমন একটা বৃষ্টির দিনেই,১২ বছর আগে তারা এক জন আর এক জন কে কথা দিয়েছিল।
সেদিন দুজনেই স্কুল শেষে পথে হাঁটছিল। অয়ন নবনীকে বলেছিল, "চল, আজ আর বাড়ি যাব না, তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজব!"
নবনী একটু হাসতে হাসতে বলেছিল, "তুমি কি জানো, এই বৃষ্টির মধ্যে আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই!"
দুজন একে অপরকে হাসির মাধ্যমে দেখছিল, এবং সেই হাসির মধ্যে ছিল অসীম ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি। সময়টা ছিল একদম নিখুঁত, নির্দিষ্ট কোন দিশা না থাকলেও, দুজনের মনে তখন শুধু একটাই কথা ছিল—"এটাই আমাদের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।"
অয়ন একে অপরকে ধরতে ধরতে বলেছিল, "তুমি কি জানো, আমি যখন তোমার পাশে থাকি, আমার সব দুঃখ ভুলে যাই। তুমি আমার আশ্রয়, তুমি আমার পৃথিবী।"
নবনী একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছিল, "তুমি যখন হাত বাড়িয়ে ধরেছিলে, তখন মনে হয়েছিল, আমাদের জীবন যেন এই হাতে আটকে গেছে—আমরা একে অপরের কাছে একসাথে থাকব চিরকাল।"
নবনী আর অয়ন একে অপরকে প্রথম দেখে স্কুলের সেই পুরনো লাইব্রেরিতে। সেখানে এক প্রাচীন বইয়ের মধ্যে হারানো গল্পের মতো একে অপরকে খুঁজে পেয়েছিল তারা। অয়ন, প্রথম যখন নবনীর দিকে তাকিয়েছিল, তার চোখে পড়েছিল সেই অদ্ভুত শান্তি—যেন একে অপরকে চেনা।
স্কুলে সব ছিল—গোলমাল, হৈচৈ, বন্ধুদের হট্টগোল, কিন্তু অয়ন আর নবনী শুধুই নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যেত। তাদের একান্ত সময় ছিল লাইব্রেরিতে, যেখানে কেউ তাদের বিরক্ত করত না। সেখানে তারা বসে থাকতো একে অপরের পাশে, চুপচাপ, বইয়ের পাতায় হারিয়ে।
একদিন, অয়ন নবনীর কাছে এসে বলেছিল, "তুমি জানো, এই বইগুলোকে ভালোবাসি—কিন্তু তোমার সাথে সময় কাটানো, সেটা একেবারে অন্যরকম অনুভূতি।"
নবনী হেসে বলেছিল, "তুমি তো বলতে পারো, এই বইগুলো আমাকে তোমার মতোই গভীরভাবে ভালোবাসতে শেখায়।
এই ভাবেই একজন আর এক জনকে ভালবাসতে শুরু করে । প্রতিদিন তারা লাইব্রেরী তে নতুন নতুন বই পড়ে।
স্কুলের মাঠে বড় অনুষ্ঠান চলছিল, সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে, হইহুল্লোড়। হঠাৎ একটা সুযোগ পেয়ে, অয়ন নবনীর হাতটা ধীরে ধীরে ধরেছিল। নবনী কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতের উত্তেজনা অয়ন অনুভব করেছিল—এটা ছিল প্রথম, কিন্তু দুইজনের মধ্যে সেই মুহূর্তটা চিরকালীন হয়ে ওঠেছিল।
এটা ছিল একেবারে নির্ভীক ভালোবাসার প্রথম প্রকাশ—যেখানে কল্পনা, ভাষা, বা সময়ের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। শুধু একে অপরকে অনুভব করা, একে অপরকে অব্যক্তভাবে বুঝে নেওয়া।
একদিন, স্কুলের টিফিন ব্রেকের সময়, অয়ন নবনীর কাছে এক কাগজে কিছু লিখে দিয়েছিল। নবনী যখন সেটি খুলে পড়ল, সে সেখানে কিছু কথার বদলে শুধু একটি ছোট্ট ছবি দেখতে পেল—দুই হাতের ছাপ।
এই ছিল তাদের ভালোবাসার প্রথম ভাষা—একটি মৃদু, অনুভূতিপূর্ণ, নিঃশব্দ উচ্চারণ।
তাদের স্কুল জীবনের ভালোবাসা ছিল কাঁচের মতো—খুব নরম, খুব ঝলমলে। সময়ের সাথে সেই ভালোবাসা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তখন ছিল নিষ্পাপ, নির্ভীক। তারা শুধু একে অপরের পাশে থাকার অনুভূতি নিয়ে অমলিন মুহূর্ত কাটিয়েছিল।
এই ভাবে দেখতে দেখতে তারা স্কুল জীবন এর সমাপ্ত করতে চলছে কেউ কারো মনে কথা মুখে বলতে পারে না। কিন্তু দুই জনেই বলার জন্য ছটফট করতেছে। আর কিছু দিন পরে তাদের পরীক্ষা শুরু হবে।
একদিন স্কুল শেষে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসা যাওয়ার পথে অয়ন ও নবমী একে অপরের হাত ধরে কথা দিয়েছিল।
একদিন, স্কুলের শেষ দিনে, তাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। নবনী আর অয়ন একে অপরকে এক ঝলক তাকিয়ে থাকে, যেন সময় থেমে গেছে। এই স্কুল জীবনের সব স্মৃতি, সেই বৃষ্টিতে ভিজে একে অপরকে হাত ধরার মুহূর্ত—সর্বোচ্চ ভালোবাসার স্বীকৃতি।
অয়ন নবনীর দিকে তাকিয়ে বলল, "এই শেষ পরীক্ষার পর... তুমি জানো, আমাদের জীবনের নতুন শুরু হবে। আমি তোমাকে সঙ্গ দিতে চাই, জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে।"
নবনী তার হাত শক্ত করে ধরে, চোখে এক চরম প্রতিজ্ঞা আর বিশ্বাস নিয়ে বলে, "আমি তোমার পাশে, এখনো, চিরকাল। পরীক্ষার পরে, জীবনের পথে একসাথে চলব।"
ফিরে যাবে তারা, না কি পরস্পরের দিকেই এগিয়ে যাবে জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য? সময় হয়তো পাল্টে যাবে, কিন্তু তাদের ভালোবাসা কখনোই হারাবে না।
এইভাবেই একের পর এক দিন কেটে যেতে লাগলো এর মধেই তারা কলেজ শেষ করে স্নাতক শেষ করে ফেলছে। তাদের ভালবাসার কোন দিনও এক বিন্দু কম করতে দেয় নাই কেউ। কিন্তু তারা হটাৎ কিভাবে যেন নিজের ভবিসতৎ নিয়ে এতটা বেস্ত হয়ে পরে যে তাদের মাঝে কন যোগাযোগ ছিল না।
আজকে ৫ বছর পরে অয়ন যখন বৃষ্টি তে নাবমীর মাথায় ছাতা ধরে হাত তা ধরে কথাগুলো বলছিল তাখন এক মুহুর্তের জন্য নবমী হারিয়ে গিয়েছিল পুরনো দিনের শ্রতিতে। শুধু মুখে ধীরে বলে, অয়ন! "তুমি... সত্যি?" বলেই জরিয়ে ধরে।
তারা এখন একে অপরকে জরিয়ে ধরে, বৃষ্টি ঝরছে তাখনো, সেই পুরনো গাছের তলায়। পৃথিবী যেন থেমে গেছে, সময়ের স্রোতও যেন তাদের কাছে হার মেনেছে। বৃষ্টির শব্দটা অদ্ভুতভাবে শান্ত—কেমন যেন এক সুর, যা কেবল তাদের হৃদয়ই শোনে।
নবনী চোখের কোণ দিয়ে এক পলক তাকায় অয়নের দিকে, আর তার ভিতর থেকে অনুভূতি গড়িয়ে আসে। চোখে এক অদ্ভুত আভা, এক রহস্যময়তা। তার মনের কথা সে সরাসরি বলতে পারে না—কিন্তু সেগুলো যেন একবারে হৃদয়ে পৌঁছায়। সে মনে মনে বলে,
"তুমি জানো না, যখন তুমি আমার পাশে থাকো, মনে হয় পৃথিবীর সব কষ্ট হারিয়ে যায়। সব কিছু এত সহজ হয়ে যায়। আজ থেকে, তুমি যদি আমার পাশে থাকো, আমি ভয় পাবো না।"
অয়ন, যেন তার মনের কথা শুনতে পায়, একটু হেসে বলে,
"এটা ছিল আমাদের শেষ না হওয়া গল্পের প্রথম শুরু। আমরা দুজন একে অপরকে হারানোর কথা কখনো ভাবিনি। জীবন যদি আমাদের কিছু পরীক্ষা দেয়, তবে আমরা একসাথে পার হয়ে যাব। তুমি আমার পৃথিবী, আর আমি তোমার আশ্রয়।"
তার এই কথা নবনীর মনে মৃদু একটা ঝড় তুলে দেয়। একসাথে কাটানো দিনের প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার হয়ে ওঠে। আর তাকে মনে মনে অনুভব করে বলে,
"আজ থেকে, কোনো কিছু আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না। আমি জানি, তোমার ভালোবাসাই আমার শক্তি। তুমি আমার সাথে, তো পৃথিবী জিততে পারি।"
আর তখনই, তাদের মাঝে এক গভীর স্নিগ্ধতা ভর করে—যেন শুধু একে অপরকে বুঝে নেওয়ার সময়, শুধু ভালোবাসার নীরব ভাষায় কথা বলার মুহূর্ত।
কেউ কেউ ফিরে আসে... সময়ের অনেক পরে, কিন্তু হৃদয়ের ঠিক সময়েই।
যদি তোমার জীবনে এমন কোনো নবনী বা অয়ন থেকে থাকে, যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো—বৃষ্টির দিনে হাত ধরে পাশে থাকবে,
তাহলে এই গল্প হয়তো তাদের জন্যই লেখা।
0 Comments